‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়/বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়’, ‘এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে/সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে’, ‘শুয়া চান পাখি আমার, শুয়া চান পাখি/আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি/ তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি/আজি কেন হইলে নীরব মেল দুটি আঁখি রে পাখি/আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘বিধি তোমার এমনই রায়, আপিল করার জায়গা নাই/কান্নাকাটি সবই মাটি, নিঠুর আদালত পাড়ায়’, ‘আমি একটা জিন্দা লাশ, কাটিস না রে জংলার বাঁশ/আমার লাইগা সাড়ে তিন হাত কবর খুঁড়িস না, আমি পীরিতের অনলে পোড়া/মরার পরে আমায় পুড়িস না তোরা’ সহ এমন অনেক গানের স্রষ্টা প্রখ্যাত বংশীবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ 'বারী সিদ্দিকী'র জন্মদিন আজ।
১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোণা জেলায় এক সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত বংশীবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ 'বারী সিদ্দিকী'। শৈশবে পরিবারের কাছে গান শেখায় হাতেখড়ি হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোণার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি কনসার্টের সময় বারী সিদ্দিকীকে অবলোকন করেন এবং তাকে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। পরবর্তী ছয় বছর ধরে তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাথে যুক্ত হন।তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষ সহ অসংখ্য গুণীশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন। পরে ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ক্লাসিক্যাল মিউজিক এর উপর পড়াশোনা শুরু করেন।
এক সময়ে বাঁশির প্রতি তুমুল আগ্রহী হয়ে ওঠেন বারী সিদ্দিকী এবং বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে এসে লোকগীতির সাথে ক্লাসিক মিউজিকের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।
বারী সিদ্দিকী সবসময়ই নিজেকে একজন বংশীবাদক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একজন বংশীবাদক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি বাঁশি বাজিয়েই শ্রোতা দর্শককে মুগ্ধ করেছেন। ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড ফ্লুট সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। একজন গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাবার আগে বারী সিদ্দিকী একজন বংশীবাদক হিসেবে বাঁশি বাজিয়েছেন প্রায় দু’দশক ধরে।
মূলত বংশী বাদক বারী সিদ্দিকী কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের প্রেরণায় নব্বইয়ের দশকে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৯৫ সালে বারী সিদ্দিকী প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপর ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে ৭টি গানে কণ্ঠ দেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা গান ছাড়াও সাধক উকিল মুন্সির জনপ্রিয় সব গান বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে অমর হয়ে থাকবে।
বারী সিদ্দিকী তার অসংখ্য গানের জন্য কালজয়ী হয়ে থাকবেন ভক্ত-অনুরাগীদের হৃদয়ে। আমাকে এখনও তার বাঁশী আর গান তুমুল মাতাল করে ফেরে।
[টিবিএন৭১/আরএস]